>
★ স্থানীয়দের কটুকথায় কান না দিয়ে জনস্বার্থে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় পেয়েছে অর্ধশতাধিক পুরস্কার।
★ নিজ এলাকা ছাড়িয়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়েও ইঁদুর নিধনে সফল হয়েছেন তিনি।
এলাকায় রয়েছে ৭০জনের বিশাল একটি টিম।
আলমগীর হোসেন
মোহাম্মদ হোসেন আহমদ প্রায় শতবর্ষী বৃদ্ধা।দেখলে বয়স ঐরকম বুঝা যায় না।উনবিংশ শতাব্দীর ৩০ দশকে জন্ম নেয়া ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের দশপাইয়া গ্রামের মৌলভী ইসরাফিলের বাড়ীর মৌলভী ইসরাফিলের সন্তান হোসেন আহমদ শিশু বয়সেই ইঁদুর নিধন দেখে অনেকটা নিজের আয়ত্ত করে পদ্ধতি গুলো।বড় ভাই মরহম মৌলভী ছিদ্দিক আহমেদ কাঠের টুকরো (তক্তা) দিয়ে ইঁদুর নিধনের জন্য ফাঁদ তৈরী করে সফল হয়।নিজের হাতেগড়ি ভাইয়ের মৃত্যুর পর আশির দশকে সরাসরি একাজেই জড়িয়ে পড়েন তিনি। যখন ফসল গুলো টিকে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছিলো। ঠিক তখন হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ ঘোষণা করেন ইঁদুরের লেজ জমা দিলেই মিলবে গম সহ গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার।মূলত কষ্টের ফলের সূচনা তখন থেকেই।ইঁদুর মেরে লেজ জমা দিয়ে ৩ধাপে পেয়েছেন ১শত২০,১শত৬৫ ও ১২০কেজি গম।এছাড়াও সোনাগাজী উপজেলা,ফেনী জেলা কৃষি অফিস থেকে একাধিকবার স্প্রে মেশিন,চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়েও পেয়েছেন ৫টি স্প্রে মেশিন,টেলিভিশন, রেড়িও,কোদাল,খন্তি,নগদ টাকা, সম্মাননা স্মারক ও সনদ।২০২২ সালে ১২হাজার৫শত ৮৯টি ইঁদুর নিধন করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে হোসেন আহমদ।নিজ এলাকা ছাড়িয়ে উপজেলার দারোগার হাট,সমপুর,মজলিশপুর,মুহরী প্রজেক্ট ও কুমিল্লায় বিভিন্ন সময় ইঁদুর নিধনের আমন্ত্রণ পেয়ে সফলতা অর্জন করেছেন তিনি।ইঁদুর ছাড়াও তিনি কাঁঠ বিড়ালী,শিয়াল,সাপও মারতেন।তার ইঁদুর নিধনে সফলতা দেখে এলাকার অধিকাংশ কৃষক হোসেন আহমদের থেকে ইঁদুর নিধনের মেশিন গুলো ক্রয় করে নিয়ে যেতো।এবং বড় ফাঁদের জন্য তিনি নিজেই স্বেচ্ছায় যেতেন।এজন্য স্থানীয়দের থেকে কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না তিনি।তবে অনেকেই এই মহতী কাজের জন্য হোসেন আহমদকে সম্মান করতো।মাঝে মাঝে আর্থিক সহায়তাও দিতো।ইঁদুরের লেজ জমা দিলে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে সম্মাননা মেলায় তিনি ইঁদুর মারার পর তাদের লেজ গুলো সংরক্ষণ করতেন।লবন দেয়া, রৌদ্রে শুকিয়ে, প্যাকেটজাত সহ একাধিক পদ্ধতিতে এগুলো সংরক্ষণ করতো।এটির একটি দূরগন্ধ থাকায় পরিবারের লোকজনও অনেক সময় ভিন্ন চোখে দেখতো।এলাকাবাসীও তাকে কটুভাবে “লেঞ্জাআলা” বলে ডাকতো।তারপরও তিনি থেমে থাকেননি দেশের সম্পদের বিনষ্ট হবে বিধায়। তবে অধিকাংশ এলাকাবাসী তাকে সম্মানের চোখে দেখে।নিজের বড় ভাইয়ের থেকে আয়ত্ত করা পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করে আরো বেশী ইঁদুর নিধন করতে সক্ষম হচ্ছেন।তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ায় পূর্বের ন্যায় নিধন করতে না পারলেও তার রয়েছে ৭০জনের বিশাল একটি প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী।তারা এখন এলাকা ভিত্তিক কাজ চালিয়ে যাওয়ায় কিছুটা কষ্ট লাঘব হচ্ছে হোসেন আহমদের।পাশাপাশি কাজটিকে পারিবারিক ঐতিহ্য মনে করে ইঁদুর নিধনের জন্য নিজের ছেলের সন্তান(নাতি) মোহাম্মাদ ইয়াছিনকে সাথে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে,২০১৯ সালে ১২হাজার ৫২৩, ২০২০সালে ১০হাজার ৮৯০,২০২১সালে ৭হাজার, ২০২২সালে ১২হাজার ৫৮৯ ও চলতি বছরের ১০ই নভেম্বর পর্যন্ত ১০হাজার ১২৬টি ইঁদুর নিধন করেছে। পরিসংখ্যান বলছে শুরু থেকে অদ্যবধি পর্যন্ত প্রায় ৬লক্ষাধিক ইঁদুর নিধন করেছে হোসেন আহমদ।এক জোড়া ইঁদুর বছরে চক্রবৃদ্ধি হারে ২হাজার বাচ্ছা জন্ম দিতে পারে।ইঁদুর গুলো একবার গর্ভবতী হওয়ার পর ৩দিনের মাথায় পূণরায় বাচ্ছা নেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে পাশাপাশি একটি ইঁদুর প্রতিদিন তার ওজনের ১০ গুন খাবার খায় এবং ১০গুন খাবার নষ্ট করে।তাহলে বুঝাই যাচ্ছে হোসেন আহমদ দেশের কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি রোধ করেছে।এজন্য অনেকে হোসেন আহমদের জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত করার দাবী তোলেন।ফসলী মাঠে কাজ করা পঞ্চাষোর্ধ বিবি খাদিজা বলেন,নিজের ফসলী মাঠে নিজেরাই কাজ করি। ফসল ঘরে আনা কষ্টকর হয়ে পড়ে ছিলো।ঘরে ধান আনলেও সেখানে আরো খারাপ অবস্থা।হোসেন আহমদ মেশিন বসিয়ে ইঁদুর নিধন করার ফলে আমাদের দুশ্চিন্তা কেটেছে।দশপাইয়া গ্রামের গৃহিনী পারভীন আক্তার বলেন,বাড়ীর অনেক কাপড়চোপড় নষ্ট করে ফেলে ইঁদুর।হোসেন চাচার কাজের কারণে আমরা এখন অনেক শান্তিতে আছি।কলেজ শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সাকিব বলেন,সবসময়ই ইঁদুরের কারণে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।হোসেন আহমদ জেঠার কারনে ইঁদুর থেকে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।হাফেজ মমতাজ উদ্দিন সমাজের সদস্য মহি উদ্দিন বলেন,উনিতো আমাদের জন্য দেশের জন্যই কাজ করছেন। রক্ষা করছে অগণিত সম্পদ।আমরাও হোসেন আহমদ চাচাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করি।মঙ্গলকান্দি দিঘীর পাড় বাজারের ব্যবসায়ী বেলায়েত হোসেন বলেন, আমরা দিনে কাজ করে রাতে বাড়ীতে চলে যাওয়ার পর ইঁদুরের যন্ত্রনায় অনেক জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যেতো। তখন হোসেন আহমদকে বলার পর তিনি মেশিন বসিয়ে দিতেন। এবং প্রতিদিন ৪-৫টা ইঁদুর আটকা পড়ে।মঙ্গলকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বাদল বলেন, অতীতে লেজ জমা দিয়ে চাল-গম সহ বিভিন্ন পুরস্কার পেলেও এখন সে রকম পাওয়া যায় না।তবে বাৎসরিক হিসেবে সামান্য পরিমাণ আর্থিক সহায়তা করা হয়।যা একজন কৃষকের জন্য চলা বহু কষ্টের বিষয়।তাই যে মানুষটি নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় বিসর্জন দিয়ে দেশের উপকার করছে। তাকে জাতীয়ভাবে সম্মানিত করা উচিত।পাশাপাশি তাকে যাতে কেউ কটুকথা না বলে সেজন্য অনুরোধও করেন তিনি।উপ সহকারী উদ্ভিদ সংক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মজিব উদ্দিন চৌধুরী বলেন,মাঠ ফসল ৫-৭ ভাগ,গুদাম জাত ফসল ৩-৫ ভাগ,সেচ নালা ৭-১০ ভাগ ফসলের নষ্ট সহ ইঁদুরের মাধ্যমে ৬০ ধরণের রোগ ছড়ায়। হোসেন আহমদ ইঁদুর নিধনের মাধ্যমে কত উপকার করেছে তা মুখে বলে শেষ করা যাবেনা।এছাড়াও সে নিঃস্বার্থে কাঠ বিড়ালী, শৃগাল ও বিষাক্ত সাপও মেরে মানুষের উপকার করে যাচ্ছে।উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আল আমিন শেখ বলেন,২০২২সালে সারাদেশে ১কোটি ৬৫লাখ ইঁদুর নিধন করে ১লাখ ২৩মেট্রিকটন ফসল রক্ষার মাধ্যমে ৪৯৪কোটি টাকা রক্ষা পেয়েছে।প্রতিবছর ইঁদুর ৫০-৫৪লাখ মানুষের খাবার নষ্ট করে।হোসেন আহমদ ইঁদুর নিধনের মাধ্যমে দেশের সম্পদ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান জানান, নিজ উদ্যোগে ৬লক্ষাধিক ইঁদুর নিধন করা সহজ বিষয় নয়।দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন কটুকথাকে উপেক্ষা করে এ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় তার জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা রইলো।পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনও তার জন্য সবসময়ই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।উপজেলা চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন জানান, মোহাম্মদ হোসেন আহমদ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছে।তার কাজের প্রতি আন্তরিকতার কারণে সে দেশব্যাপী প্রশংসা লাভ করেছে।পেয়েছে অর্ধশতাধিক পুরস্কার। তার প্রয়োজনে আমরাও পাশে থাকবো।ইঁদুর নিধনকারী দশপাইয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন আহমদ বলেন,ভাইয়ের দেখাদেখি আমি ইঁদুর মারার কাজে লেগে পড়ি। ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমি নিজেই বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে হাজার হাজার ইঁদুর নিধন করতে থাকি।উপজেলা প্রশাসনের নজরে আসায় উৎসাহ পেয়ে লাখ লাখ ইঁদুর নিধন করতে সক্ষম হয়েছি।আমার ছোট্ট ইয়াছিন নামে নাতি রয়েছে।সে এখন আমার সাথে বিভিন্ন সময় ইঁদুর নিধন করতে যায়।তাকেই ভালো করে প্রশিক্ষণ দেবো।আমার তো অনেক বয়স হয়ে গেলো আগের মত আর পারিনা।দেশের সম্পদ রক্ষায় নিজের মানসিকতা তৈরি করেছি।অনেকে আমাকে কটুকথা বলেছে।নাম দিয়েছে “লেঞ্জাআলা হোসেন”।তাতেই আমি থেমে থাকিনি।এখন এলাকায় ৬০-৭০জনের মত লোক আমার দেয়া প্রশিক্ষন মত কাজ করে ইঁদুর নিধন করছে আমি লেংটি, গেছু, মাটির,কালো,কালো রাজা, সাদা ইঁদুর ছাড়াও কাঠবিড়ালি,সাপ,শৃগাল ও বাভল নিধন করছি।আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।কিন্ত দেশের সম্পদ বিনষ্টকারী ইঁদুরের কাছে আমরা পরাধীন।তাই সকলের উচিত ইঁদুর নিধনে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা।টাকার আসা করিনি।তারপরও ৫০টিরও বেশী পুরস্কার পেয়েছি।নগদ অর্থও পেয়েছি।দেশ ও মানবতার সেবায় আমৃত্যু কাজ করে যাবো।
Leave a Reply